How reasonable is working on the computer at night

কম্পিউটারে রাত জেগে কাজ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

ইদানিংকালে রাতজেগে কম্পিউটারে কাজ করার কথা শুনলে, প্রথমেই মাথায় আসে একজন ফ্রিল্যান্সার এর কথা। যিনি রাত জেগে কাজ করে আয় করেন বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিটেন্স আয় করার মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অবদান রাখেন। কিন্তু এ রাত জাগা নিয়ে আছে অনেক বিতর্ক। শরীর, মন এবং সামগ্রিক  জীবনের উপরে রাতজাগা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে। রাত জেগে কাজ করার পক্ষে ও বিপক্ষে আছে নানা যুক্তি। আজকের এই আর্টিকেলে আমরা রাত জেগে কাজ করা উচিত নাকি অনুচিত তা নিয়ে আলোচনা করব। মুদ্রার এপিঠ ওপিট নিয়ে চুল-চেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আপনাদের সামনে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করব।

দিন কাজের জন্য ও রাত বিশ্রামের জন্য। প্রাকৃতিকভাবে আমরা এভাবেই গড়ে উঠেছি। প্রকৃতির অন্যান্য সব নিয়মের মতোই আমাদের জীবনেও এই নিয়মেরই অনুগত। কিন্তু বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক বিষয়ের কারণে আমাদের অনেক সময় রাত জাগতে হয়। রাতে জেগে থাক এই মানুষগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম বড় অংশ হলেন ফ্রিল্যান্সাররা। 

একজন ফ্রিল্যান্সার বেশিরভাগ সময় কাজ করে থাকেন ইউরোপ-আমেরিকা বা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর ক্লায়েন্টদের সাথে। আমরা জানি সেসব দেশে যখন দিন আমাদের এখানে তখন রাত। সময়ের এই অসামঞ্জস্যতার কারণে আমাদের ফ্রিল্যান্সারদেরকে রাত জেগে কম্পিউটারে কাজ করতে হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে গিয়ে রাত জেগে কম্পিউটারে কাজ করার ফলে শরীরের ওপর কি কি প্রভাব পরে প্রথমে সেগুলো জেনে নেওয়া যাক। 

. স্বাভাবিক ঘুমের বিঘ্ন ঘটা ও মস্তিষ্কের ক্ষতি। 

আমি জানি ভালো ঘুম শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের ঘুম না হলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়। মস্তিষ্কের কোষগুলোর চরম ক্ষতি হয়। কোষগুলো ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায়। ঘুমের সময় আমাদের শরীর বিশ্রাম নেয়। যদি এই বিশ্রাম ঠিকমতো না হয় তাহলে শরীরের বিভিন্ন রকম অসুখ বাসা বাঁধতে শুরু করে। ভালো ঘুমের প্রথম শর্ত হলো রাতে ঘুমানো। আপনি দিনে যত সময় নিয়েই ঘুমান আপনার ঘুম পরিপূর্ণ হবে না। সুস্বাস্থ্যের পরিভাষায় যাকে আমরা বলে থাকি কোয়ালিটি স্লিপ তার জন্য রাতে ঘুমানো অত্যন্ত প্রয়োজন।

২.উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা।

সঠিকভাবে ঘুম না হওয়ার কারণে রক্তচাপ এবং রক্ত সঞ্চালন জনিত সমস্যা দেখা দেয়। 

৩. হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি । 

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারি যারা রাতে কাজ করেন তাদের মধ্যে হার্ট এটাকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রায় ৭% বেশি থাকে। রক্তচাপ জনিত সমস্যার কারণে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।

৪. স্থুলতা ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি।

রাত রাত জেগে কাজ করে দিনে ঘুমালে স্থুলতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। প্রধান কারণ হলো হরমোনের ভারসাম্যহীনতা। এটি অনেক ভয়াবহ একটি বিষয়। কারণ আপনি যদি সুষম খাবারও গ্রহণ করেন তারপরও আপনার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

৫. বিভিন্ন পেটের অসুখ।

রাতে জেগে থাকার ফলে আপনি আপনার শরীরকে শরীরের স্বাভাবিক নিয়মের বিরুদ্ধে চালিত করছেন। এর অন্যতম একটি প্রভাব হচ্ছে আপনার পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি হওয়া। এতে করে পুরো পরিপাকতন্ত্রই আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে যায়। 

লিভার, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত এবং বৃহদানন্ত্র ইত্যাদি সকল অঙ্গেরই ক্ষতি সাধিত হয় এবং আস্তে আস্তে তা প্রকট টাকার ধারণ করে। এমন কি এই অঙ্গগুলোতে ক্যান্সারও হতে পারে।

৬. ক্যান্সারের ঝুঁকি 

রাতে জেগে কাজ করার ফলে মানুষের শরীরের সারকার্ডিয়ান ক্লক বা বায়োলজিক্যাল ক্লক চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে বায়োলজিক্যাল ব্লকের এই ভারসাম্যহীনতা শরীরে ক্যান্সারের কোষগুলোর জন্ম এবং বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যান্সারবিষয়ক গবেষণা বিভাগ ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের তথ্য মতে, সূর্যের আলো যখন থাকে না তখন শরীররে ওপর জোর খাটিয়ে জাগিয়ে রাখা শরীরে মেলাটনিন হরমোন তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করে। আর এই মেলাটনিন মানুষের দেহে টিউমারের বৃদ্ধিকে রোধ করে। এতে তাঁরা ধারণা করেছেন, রাত জাগা মানুষদের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। 

৭. মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া। 

রাতে কাজ করলে একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যারা রাতে কাজ করে তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষের তুলনায় ডিপ্রেশন, মুড ডিসঅর্ডার কিংবা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি।

৮. চোখের ক্ষতি।

রাতজেগে কম্পিউটারে কাজ করলে চোখেরও ব্যপক ক্ষতি হয়। কারণ রাতে সাধারণত আমরা কাজ করি সব আলো বন্ধ রেখে। এতে করে কম্পিউটার স্ক্রিনের আলো চোখের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়াও রাতে জেগে থাকাটাই চোখের জন্য একটি হুমকি সরূপ।  

৯. ভিটামিন ডি এর অভাব।

আমরা জানি, সূর্যের আলো ভিটামিন ডি অন্যতম প্রধান উৎস। রাত জেগে কাজ করে দিনে ঘুমানোর ফলে আমরা এটি থেকে বঞ্চিত হই। ভিটামিন ডি এর অভাবে চুল পড়া, অস্থি সন্ধির অসুখ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা হয়।

১০. পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপন ব্যাহত হওয়া।

যেহেতু আপনি রাত জেগে কাজ করছেন এবং দিনে ঘুমিয়ে থাকছেন সেহেতু আপনার সামাজিক জীবন বলতে কিছুই থাকছে না। কারণ বেশিরভাগ পারিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠান হয় দিনে। মানুষজন সামাজিকভাবে মেলামেশা করে দিনে। বিভিন্ন খেলাধুলা, আড্ডা, সামাজিক জমায়েত বা গেট টুগেদার  দিনে হবার কারণে আপনি এগুলো থেকে বঞ্চিত থাকবেন। ফলে ধীরে ধীরে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন। আপাতদৃষ্টিতে এটিকে সমস্যা মনে না হলেও এটির একটি সুদূরপ্রসারি প্রভাব রয়েছে। অনেক দিন এভাবে চললে আপনি ধীরে ধীরে একজন অসামাজিক মানসিকতার মানুষে পরিণত হবেন।

ওপরের আলোচনা থেকে আমাদের আমাদের সামনে পরিষ্কার হলো যে রাত জেগে কাজ করা আমাদের জন্য কত বড় ক্ষতি ডেকে আনে। রাত জেগে কাজ করার ফলে আমাদের পারিবারিক, সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক সকল দিক থেকে ক্ষতি সাধিত হয়। রাত জাগার প্রভাবগুলো শরীরে খুব তাড়াতাড়ি প্রকট আকার ধারণ না করলেও অদূর ভবিষ্যতে এগুলো নানান ভয়াবহ রোগের জন্ম দেয়। 

কিন্তু আমরা ফ্রিল্যান্সাররা রাত জাগার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যেতে পারি না। কারণ যদি আমরা ইউরোপ বা আমেরিকার ক্লায়েন্টদের সাথে কাজ করতে চাই এবং ভালো উপার্জন করতে চাই তাহলে রাতজাগা আমাদের জন্য বাঞ্ছনীয়।

আমি নিজে গত প্রায় ১২ বছর ধরে ফ্রিল্যান্সিং এর সাথে যুক্ত আছি। আমি একজন সার্টিফাইড এস.ই.ও এক্সপার্ট ও ট্রেইনার। এর সাথে আমি একজন টপলেটেড ফ্রিল্যান্সারও বটে। আমার ব্যক্তিগত কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি রাত জেগে কাজ কোনভাবেই দীর্ঘদিন ধরে করা উচিত নয়। আমার পরামর্শ হলো, এক্ষেত্রে আমরা কিছু কৌশল অবলম্বন করতে পারি। বিশেষ করে আমরা যারা মুসলিম আছি তাদের জন্য আমার পরামর্শ থাকবে আপনারা এশার নামাজের পরই ঘুমিয়ে যান এবং রাত আড়াইটা বা তিনটায়  ঘুম থেকে ওঠেন এবং কাজে বসে যান। এতে করে ইউরোপ বা আমেরিকার ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবেন এবং কাজ করতেও আপনার সুবিধা হবে। 

উপসংহার 

কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন।

“মহান আল্লাহপাক আমাদের জন্য রাতকে বিশ্রাম বা আরামের জন্য আর দিনকে কাজকর্মের জন্য নির্ধারণ করেছেন।” (আল কুর’আন- ৬:৯৬; ১০:৬৭; ২৫:৪৭)

হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি আমাদের প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) এশার নামাজ এক-তৃতীয়াংশ রাত পরিমাণ দেরি করে পড়া পছন্দ করতেন, আর এশার আগে ঘুমানো এবং এশার পর না ঘুমিয়ে গল্পগুজব করা অপছন্দ করতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯৯)

আরেকটি হাদিসে এসেছে  ‘সকালবেলায় রিজিকের অন্বেষণ করো! কেননা সকালবেলা বরকতময় ও সফলতা অর্জনের জন্য উপযুক্ত সময়। ’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ৬২২০)

সুতরাং আমাদের ধর্মীয় এবং ব্যবহারিক জীবনের আলোকে বলা যায় রাতে আমাদের জেগে কাজ না করাই উচিত। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে যতটা রাতে কাজ এড়িয়ে চলা যায়। এক্ষেত্রে আমরা ইসলামী মডেলটি খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে পারি। এতে আমাদের ঘুম পরিপূর্ণ হবে এবং কাজের ক্ষেত্রেও আমরা পরিপূর্ণরূপে নিজেদেরকে সঁপে দিতে পারব। 

আশা করি, রাতজেগে কম্পিউটারে কাজ করা উচিত নাকি অনুচিত এ নিয়ে আপনাদের মনে থাকা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আমি সক্ষম হয়েছি। এ বিষয়ে আপনাদের যেকোনো মতামত বা প্রশ্ন কমেন্টের মধ্যে করতে পারেন। আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর আমি কমেন্টের মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করবো।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *