ফ্রিল্যান্সারদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার উপায়।
বর্তমান সময়ে ফ্রিল্যান্সিং মানে উন্নত জীবনের হাতছানি। বিদেশি মুদ্রা আয় করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের উজ্জ্বল সম্ভাবনা। ফ্রিল্যান্সার গুছিয়েছে বেকারত্বের গ্লানি। স্বাধীনভাবে কাজ করে গতানুগতিক চাকুরীর বাইরে গিয়ে দীপ্তিমান উদাহরণ স্থাপন করেছেন আমাদের সমাজে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সাররা তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে বরাবরই উদাসীন থাকেন। আমরা ইতোমধ্যেই আলোচনা করেছি কিভাবে ফ্রিল্যান্সাররা তাদের শরীরের যত্ন নেবেন।
শরীরের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি নিজের মনের বা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়াটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমরা প্রায় এই বিষয়টি এড়িয়ে যাই। আমাদের দেশে এটি নিয়ে খুব একটা বেশি কথাবার্তা হতে দেখা যায় না। বর্তমানে বিভিন্ন রকম আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে মানসিক সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফ্রিল্যান্সাররাও রয়েছেন অনেক বেশি ঝুঁকিতে। এর কারণ হলো ফ্রিল্যান্সাররা অনিয়মিত জীবন যাপন করেন না। এমনকি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না ঠিকমতো ঘুমান না অর্থাৎ তারা ঠিকমতো বিশ্রাম নেন না। এমন অনিয়ন্ত্রিত এবং শৃঙ্খলা বিহীন জীবন যাপনের কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশাল ঝুঁকিতে রয়েছেন। একজন ফ্রিল্যান্সার কিভাবে তার মানসিক স্বাস্থ্যের বা তার মনের যত্ন নেবেন আমরা এই আর্টিকেলে সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব।
সঠিকভাবে এবং সঠিক সময় ঘুমানো।
আমরা প্রায় দেখতে পাই ফ্রিল্যান্সাররা রাত জেগে কাজ করেন। অবশ্য এর পিছনে একটি কারণ রয়েছে। কারণটি হল বেশিরভাগ ভালো ক্লাইন্টরা সাধারণত ইউরোপ বা আমেরিকা থেকে আসেন। তাদের সময় অনুযায়ী কাজ করতে হলে রাতে কাজ করতে হয়। এ কারণে একজন ফ্রিল্যান্সার রাতে ঘুমাতে পারেন না। এখন কথা হল আপনি দিনে ঘুমিয়ে ভালো ঘুম বা যাকে আমরা বিজ্ঞানের ভাষায় বলি কোয়ালিটি স্লিপ সেটি কোনভাবেই পাবেন না। আর কোয়ালিটি স্লিপ না হলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে তার কর্ম ক্ষমতা হারায়। মেজাজ হয় খিটখিটে শরীর ও মনে আসে অবসাদ।
চিকিৎসা বিজ্ঞানে রাতে ঘুমের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যারা প্রায়ই রাত জাগেন তাদের উদ্বিগ্নতা, অবসাদ ও বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভোগার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এমনকি রাতে না ঘুমানোর সঙ্গে আত্মহত্মার প্রবণতারও সম্পর্ক রয়েছে।
একাকী এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা পরিহার করে, সামাজিক জীবন-যাপন করা।
একজন ফ্রিল্যান্সার স্বনির্ভর হয়ে কাজ করেন এবং তার কাজ সম্পর্কিত সকল বিষয়ে তাকে একাই নজর রাখতে হয়। এর সাথে ফ্রিল্যান্সারদের অন্যতম একটি সুবিধা হল বাড়িতে থেকে কাজ করতে পারেন। এর ফলে তারা ব্যক্তিগত জীবন এবং পেশাগত জীবনের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। মূলত তাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে কোন কিছু থাকেই না। তারা বেশিরভাগ সময়ে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন অথবা কিভাবে কাজটি করবেন এসব নিয়ে ভাবনা-চিন্তা বা ব্রেনস্ট্রমিং করতে থাকেন। একজন ফ্রিল্যান্সারের জীবন কম্পিউটারের মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ বা আলাপচারিতায় সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে। ফলে তারা একা হয়ে পড়েন।
একজন ফ্রিল্যান্সার অনেক সময় মনে করেন যে একা একা থাকার ফলে তার সৃষ্টিশীলতা এবং কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক মহাপুরুষ, জ্ঞানী-মুনি ঋষিরা একা থাকতে পছন্দ করতেন এবং একাই সবকিছু করতেন। মনে রাখতে হবে একাকীত্ব এবং নির্জনতা এক নয়। প্রথমদিকে ফ্রিল্যান্সাররা এই একাকিত্বের বিষয়টি বুঝতে পারেন না এবং এটি নিয়ে তেমন চিন্তা করেন না কিন্তু পরবর্তীতে এই সমস্যাটি স্থায়ী হতে থাকে এবং আস্তে আস্তে একজন মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। একাকীত্ব থেকে বিষন্নতা তৈরি হয় যা বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণ।
একই সাথে একজন ফ্রিল্যান্সার পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। এটি একাকিত্বেরই একটি অন্যরূপ মাত্র। একজন ফ্রিল্যান্সার কাজ করে থাকেন রাতে এবং এ রাতে কাজ করার ফলে তাকে দিনে ঘুমাতে হয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক কিংবা পারিবারিক বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান বা জমায়েত সব দিনেই হয়ে থাকে। একজন ফ্রিল্যান্সার এসব থেকে বঞ্চিত হন এর ফলে তিনি একে একে পরিবারের সব মানুষ, বন্ধু-বান্ধব থেকে এবং পরিচিত সকল মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে চলে যান।
মানুষ সামাজিক জীব প্রকৃতিগতভাবে এসে সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করতে চায়। কিন্তু এভাবে একা এবং বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনের কারণে তার মন এবং মননের উপরে গভীর ক্ষতিকর প্রভাব পরে। একপর্যায়ে ধীরে ধীরে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার তৈরি করে।
একজন ফ্রিল্যান্সার এর উচিত নিজেকে সময় দেওয়া। নিজের পরিবারের সাথে, বন্ধু-বান্ধব বিশেষ করে নিজের প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানো। এতে করে ভাবের আদান-প্রদান হয়। হৃদয় থেকে উষ্ণ। প্রকৃতিগতভাবে মানুষদের সামাজিক জীব তার চর্চা হয় এবং মন প্রফুল্ল থাকে। শুধু একজন ফ্রিল্যান্সার নয় প্রত্যেকটি মানুষেরই নিজের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য সামাজিকভাবে মেলামেশা পরিবারের সাথে সময় কাটানো অত্যন্ত জরুরী।
মেডিটেশন।
একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য মেডিটেশন অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। এর একটি ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে প্রত্যেকটি ধর্মে মেডিটেশন কথা বলা রয়েছে।
বিশেষ করে যারা মুসলিম আছেন তাদের জন্য এটি করা আরো সহজ। নিয়মিত নামাজ পড়া এবং সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এ চর্চাটি আপনি করতে পারেন।
কাজের জায়গায় এবং নিজের থাকার জায়গা আলাদা করা।
একটি অফিসে গিয়ে কাজ করলে ব্যক্তিগত জীবন এবং কর্মজীবনের মধ্যে একটি ভারসাম্য বজায় রেখে জীবন যাপন করা সহজ হয়। কিন্তু একজন ফ্রিল্যান্সারের জন্য কাজটি মোটেও সহজ না। সাধারণত একজন ফ্রিল্যান্সার নিজের বাড়িতে বসে কাজ করেন। এতে করে তার নিজের থাকার জায়গাটির কাজের জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। এতে করে কাজের জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে ব্যাপক প্রভাব পরে।
নিজের ব্যক্তিগত পরিচয় এবং পেশাগত পরিচয় আলাদা করা।
মানসিক প্রশান্তির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তিগত পরিচয় পেশাগত পরিচয় এক হলেও নিজের কাজের জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে আমাদের উচিত কাজের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আলাদা একটি পরিচয় বহন করা। যেমন কাজের জন্য আলাদা ফোন নাম্বার, আলাদা ইমেইল ইত্যাদি ব্যবহার করা। এতে করে আপনি নিজেকে সময় দিতে পারবেন এবং অহেতুক বিরক্ত হবেন না।
নিয়মিত বিরতি নেওয়া।
যেকোনো কাজের ক্ষেত্রে নিয়মিত বিরতি নেওয়া খুবই উপকারী। বিরতি নেওয়ার ফলে আপনার মন ও শরীর দুটোই বিশ্রাম পায়। শরীর ক্লান্ত হলে আমরা বিরতি নিয়েই ঠিকই কিন্তু মনের দিকটা খেয়াল করি না। আমাদের মনেরও বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। বিশ্রামের ফলে কর্মদক্ষতা এবং কর্মক্ষমতা যেমন বাড়ে সৃষ্টিশীলতাও বাড়ে, এবং একজন ফ্রিল্যান্সারের কাজের মান অনেক বেড়ে যায়। আমাদের আধা ঘন্টা বা একঘন্টা পরপর নিয়মিত বিরতি অবশ্যই নিতে হবে।
যেকোন কাজ যদি সেটি চাপ সৃষ্টি করে তাহলে তো ছেড়ে দেওয়া।
ফ্রিল্যান্সাররা কোন কাজই ছেড়ে দিতে চান না। অবশ্য এর পেছনে অনেক কারণও থাকে। যেমন রেটিং কমে যাওয়া, মার্কেট প্লেসে খারাপ ইম্প্রেশন তৈরী হওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এসব কিছু কে ছাপিয়ে একজন ফ্রিল্যান্সারকে মনে রাখতে হবে শরীর ও মনের যত্নটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শারীরিক এবং মানসিক ভাবে ভালো থাকলে কাজ আসবে কিন্তু অসুস্থ্যতা অনেক বেশি ক্ষতিসাধন করবে।
নিয়মিত ব্যায়াম করা।
আমরা মনে করি ব্যায়াম শুধু শরীরের জন্য দরকারী। আসলে তা নয়। ব্যায়াম আমাদের শরীরকে যেমন চাঙ্গা রাখে ঠিক তেমনি আমাদের মনকেও প্রফুল্ল রাখতে সহায়তা করে।
নিজের কাজের জন্য একটি রুটিন ঠিক করা
আমরা উপরে যে কয়টি পয়েন্ট আলোচনা করেছি সেগুলো মূলত একটি রুটিনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেয়া সম্ভব। নিজের কাজের জন্য একটি সুবিধা মত রুটিন তৈরি করে না। এতে করে তার কাজগুলো গুছিয়ে করতে সুবিধা হবে তার শরীর এবং মনের উপরে অতিরিক্ত চাপ পড়বে না এবং শরীরও মন ভালো থাকবে।
নিজের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজন বোধে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার এর পরামর্শ নেওয়া।
এই আধুনিকতার চরম শিখরে পৌছানোর পরেও আমাদের দেশে মানসিক সমস্যাকে এক প্রকার ট্যাবু হিসেবেই দেখা হয়। এর ফলে বেশিরভাগ মানুষই এ নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া তো দূরের বিষয় কথা বলতেও ভয় পান। এই ভয় নামক অদৃশ্য শক্তিকে জয় করতে হবে। নিজেকে এবং নিজের পরিবারের মানুষকে সতর্ক ও সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।
আরো জানুন: চোখের যত্নে একজন ফ্রিল্যান্সার যা যা করবেন
উপসংহার
একজন মানুষকে তখনই সুখি বলা যায় যখন তিনি শারীরিক এবং মানসিক ভাবে সুস্থ্য। শরীরের যেমন যত্ন প্রয়োজন তেমনি ঠিক মনেরও যত্ন নেয়া প্রয়োজন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবাটা অনেক বেশি জরুরি। কারণ মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা গুলো সহজে ধরা পরে না। আবার ধরা পরলেও বেশ দেরীতে ধরা পরে। এজন্য একজন ফ্রিল্যান্সার এর উচিত এসব বিষয়ে সচেতন থাকা।
বর্তমানে ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। অনেক ফ্রিল্যান্সার দীর্ঘদিন কাজ পাচ্ছেন না। কাজ পেলেও সঠিক পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এসব নানা বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে হতাশা ও অবসাদ যা থেকে সৃষ্টি হতে পারে মানসিক সমস্যার।
আশাকরি এই আর্টিকেল থেকে একজন ফ্রিল্যান্সার তার মানসিক সাস্থ্য নিয়ে সচেতন হবেন এবং কিভাবে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন তা আপনি এতক্ষনে বুঝে ফেলেছেন। এ বিষয়ে আপনাদের যেকোনো মতামত বা প্রশ্ন কমেন্টের মধ্যে করতে পারেন। আপনাদের সকল প্রশ্নের উত্তর আমি কমেন্টের মধ্যে দেয়ার চেষ্টা করবো।