ই কমার্স কী? বাংলাদেশে ই কমার্স এর ভবিষ্যত
অনিশ্চিত চাকরির বাজারে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি কিংবা নিরাপদে জীবিকা নির্বাহ করে স্বাবলম্বীতা অর্জনে ই কমার্স এর যে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রয়েছে, তা আপনি জানেন কি? ডিজিটাল বিশ্বে ই কমার্স এর মাধ্যমে বহু মানুষ লাখ লাখ টাকা আয় করছে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, ই কমার্স আসলে কী?
চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমি মো ফারুক খান, আজকের এই আর্টিকেলে ই কমার্স সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
ই কমার্স কী, ই কমার্স এর ধরন, ই কমার্স এর সূচনা, সুবিধা, অসুবিধা, বাংলাদেশে ই কমার্স এর ভবিষ্যত, কোনধরনের ব্যবসার ই কমার্স করা উচিত এবং কেন করা উচিত এমন যাবতীয় প্রয়োজনীয় বিষয় থাকছে আজকের আলোচনায়। আমি এই আর্টিকেলে যথাসম্ভব সহজ ভাষায় ই কমার্স নিয়ে আলোচনা করবো, যাতে করে আপনাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা না হয়।
এবার চলুন, মূল আলোচনায়
ই কমার্স কী
ইন্টারনেট কমার্স এর সংক্ষিপ্ত রুপ হলো ই কমার্স।
একটু বিস্তারিত জানা যাক-
ইন্টারনেট সেবা ব্যবহার করে অনলাইনে পণ্য বা সেবা কেনাবেচা বা আদান-প্রদানের যে প্রক্রিয়া, সেটাই মূলত ই কমার্স।
আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে ই কমার্সের কিছু উদাহরণ দেয়ার চেষ্টা করছি। যেমন, অনলাইনে যেকোনোধরনের পণ্য বেচাকেনার জন্য আছে Amazon কিংবা দেশীয় Daraz এর মতো জনপ্রিয় ই কমার্স।
আবার ধরুন, আমরা যে ই লার্নিং এর মাধ্যমে ঘরে বসেই বিভিন্ন গূরুত্বপূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করে নিজেদের স্কিল বাড়াচ্ছি তাও ই কমার্সের মাধ্যমেই। তেমন জনপ্রিয় দুটি ই কমার্স হলো linkdIn Learning এবং Coursera তেমন দুইটি ই কমার্স।
তেমনি অনলাইনে টিকিট কাটার জন্য রয়েছে Shohoz, কিংবা অনলাইনে ঘরের নানা কাজ যেমন, এসি ক্লিন করা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, সবধরনের সেবা দেয়ার জন্য রয়েছে sheba.xyz।
ই কমার্স কত প্রকার?
ই কমার্স কিন্তু অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এখানে আমি ই কমার্সের প্রধান কয়েকটি ধরন সম্পর্কে বলার চেষ্টা করবো।
ই কমার্স প্রধাণত পাঁচ ধরনের হয়ে থাকে। সেগুলো হলো- বি টু বি (B2B), বি টু সি (B2C), সি টু সি (C2C), বি টু জি (B2G), সি টু বি (C2B) এবং সি টু জি (C2G)।
চলুন, একটু বিস্তারিত জানা যাক।
১) বি টু বিঃ বি টু বি এর পূর্ণরূপ বিজনেস টু বিজনেস । ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার যে ব্যবসায়িক লেনদেন প্রক্রিয়া, তাই বি টু বি। যেমন, প্রস্তুতকারক থেকে পাইকারী বাজার, সেখান থেকে খুচরা বাজারের মধ্যে যে ব্যবসায়িক লেনদেন তা বি টু বি ধরনের ই কমার্স।
২) বি টু সিঃ বি টু সি হলো বিজনেস টু কনজিউমার। অর্থাৎ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ভোক্তার মধ্যেকার বেচাকেনার প্রক্রিয়াটি বি টু সি। যেমন, chaldal.com, daraz.com এধরনের ই কমার্স।
৩) সি টু সিঃ সি টু সি মানে হলো কনজিউমার টু কনজিউমার। এর অর্থ, ভোক্তা এক্ষেত্রে নিজেই বিক্রেতা হয়ে নিজস্ব পণ্য বা সেবা অন্য ভোক্তার কাছে বিক্রি করেন বা করতে চান। যেমন, eBay বা bikroy.com এমন দুটি ই কমার্স সাইট। এখানে ভোক্তা তার নিজের পণ্য দরকার অনুযায়ী বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্য ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারবেন।
৪) বি টু জিঃ বিজনেস টু গর্ভনমেন্ট হলো বি টু জি। এই ই কমার্স মডেলে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বা সেবা সরকারের কাছে বিক্রি করে। ইলেক্ট্রনিক ফর্ম বা পেমেন্ট জমাও এই মডেলের ই কমার্স। যেমন, সরকার পদ্মা সেতু নিমার্ণের জন্য চায়না প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটড কে কিংবা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য ইন্টার RAO ইঞ্জিনিয়ারিং, গোল্ডেনবার্গ গ্রুপ অফ কোম্পানি এবং হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি কে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেগুলো বি টু জি মডেলের ই কমার্স।
৫) সি টু বিঃ সি টু বি এর পূর্ণরূপ হলো কনজিউমার টু বিজনেস। এই মডেলে ভোক্তা তার কোনো কাজ বা সেবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারেন। যেমন, Upwork সাইটটিতে ভোক্তা তার কাজের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছে তার কাজ বিক্রির প্রয়াস চালাতে পারেন।
ধরুন, আপনি ভালো ওয়েব ডিজাইন করতে পারেন। Upwork এ আপনার পোর্টফোলিও দিয়ে রাখলে, নির্দিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের জন্য আপনার কাছে আসতে পারে। এতে করে, আপনি সি টু বি মডেলের আওতায় তাদের কাছে আপনার কাজ বা সেবা বিক্রি করতে পারছেন।
৬) সি টু জিঃ কনজিউমার টু গর্ভনমেন্ট, সংক্ষেপে সি টু জি। ভোক্তার কাছ থেকে সরকারের কাছে লেনদেনের প্রক্রিয়াটি হলো সি টু জি। এধরনের ই কমার্স মডেলে ভোক্তা এবং সরকারের মধ্যে কোনো তথ্য বা পরিষেবার লেনদেন হয়ে থাকে। যেমন, সরকারকে যে আমরা অনলাইনে বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছি, ট্যাক্স দিচ্ছি, এগুলো সবই সি টু জি মডেলের আওতাধীন।
এই ই কমার্সের অনেক সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি অল্প সংখ্যক অসুবিধাও আছে। নীচে উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা এবং অসুবিধার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি-
ই কমার্স এর সুবিধা
- ই কমার্সের প্রধান সুবিধা হলো, এই প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধতা অনেক কম। ই কমার্সের ক্ষেত্রে সময়ের যেমন সীমাবদ্ধতা নেই, আবার ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতাও নেই। যেকোনো জায়গায় যেকোনো সময় এ প্রক্রিয়ায় আপনি পণ্য, সেবা বা তথ্যের আদান-প্রদান করতে পারবেন। ই কমার্স সাইটগুলো সপ্তাহের ৭ দিনই ২৪ ঘন্টা চলমান থাকে। ফলে, যেকোনো সময় ভোক্তার সাথে সংযুক্ত হয়ে ই কমার্স কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া যাবে।
- ই কমার্সের মাধ্যমে অল্প মূলধন দিয়ে আপনি ব্যবসা শুরু করতে পারবেন। যেহেতু অনলাইনেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত হবে, তাই ঘরে বসেই কাজ করে আপনি ব্যবসা চালিয়ে নিতে পারবেন এবং নির্বিঘ্নে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।
- ই কমার্স ব্যবসা করা তুলনামূলক সহজ। যেমন ধরুন, আপনি কোনো ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ই কমার্স বিজনেস করছেন। এতে, অনলাইনেই বেশিরভাগ কাজ মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে থাকে, তাই কম লোক নিয়েও ই কমার্স ব্যবসা চালানো যাবে। আবার আপনি চাইলেই ভিন্ন ভিন্ন পণ্য বা সেবা নিয়ে একইসাথে কয়েকটি ই কমার্স পরিচালনা করতে পারবেন।
- ই কমার্সের মাধ্যমে আমরা ঘরে বসেই যেকোনো দরকারি জিনিস যেকোনো ই কমার্স স্টোর থেকে পছন্দ করে কিনতে পারি, সেটি আমাদের ঘরে পৌঁছে দেয়া হয়। আবার, অনলাইনে ই কমার্সের মাধ্যমে, প্রয়োজনীয় ফর্ম জমা করা থেকে শুরু করে, শিক্ষাগ্রহণ, বিভিন্ন বিল পরিশোধের মতো দরকারি কাজগুলোও ঘরে বসেই সেরে নিতে পারি। এতে করে,আমাদের সময় এবং শ্রম দুটোই বেঁচে যায়।
- একজন ভোক্তা হিসেবে আমরা, ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেকোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে মূহুর্তের মধ্যে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে থাকা বিশাল ই কমার্স মার্কেটপ্লেস থেকে পছন্দের জিনিস খুঁজে নিয়ে কিনতে পারবো। আবার, একজন বিক্রেতা হিসেবে এই বিশাল মার্কেটপ্লেস থেকে কাঙ্ক্ষিত গ্রাহক খুঁজে নিতে পারবো খুব সহজে।
- ই কমার্স প্রক্রিয়ায় আপনি আপনার ব্যবসা বা সেবা গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে খুব সহজে ছড়িয়ে দিতে পারবেন। তাছাড়া, এর মাধ্যমে গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তা বুঝে পণ্য বা সেবার গুণগত মান পরিবর্তন করা বা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ি পণ্য সরবারাহ করে ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব। ই কমার্স ব্যবসায় গ্রাহকের সাথে অনলাইনে সরাসরি যুক্ত থেকে তাদের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া বা অর্ডার কনফার্ম করে নেয়াও বেশ সহজ। এসব কারণে ব্যবসার দ্রুত প্রচার এবং প্রসার ঘটবে।
ই কমার্সের অসুবিধা
- ব্যবসায়ি বা গ্রাহকদের মধ্যে মুখোমুখি সংযোগের কোনো সুযোগ ই কমার্সে নেই। আপনি কোনো পণ্য অনলাইন থেকে অর্ডার করতে গেলে তা ছুঁয়ে বা ঠিকমতো সরাসরি দেখে কেনার কোনো সুযোগ পাবেন না। তাছাড়া পণ্যটি অর্ডার করলেই যে আপনি তা তখনই হাতে পেয়ে যাবেন, তাও নয়, অর্ডারের পর সেটি আপনার ঠিকানায় পৌঁছাতে কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে। তবে আমাজন এর মতো কিছু ই কমার্স সাইট অর্ডারের দিনেই গ্রাহকের কাছে পণ্য ডেলিভারি করার অপশন খোলা রেখেছে। তবে, এতে আপনার অধিক ডেলিভারি খরচ দিতে হতে পারে এবং সব পণ্যের ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রযোজ্য নয়।
- যেহেতু ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো ই কমার্স প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়, তাই ইন্টারনেটের কোনোরকম সমস্যা তৈরি হলে সমগ্র প্রক্রিয়াটি থেমে যাওয়ার ঝুঁকি দেখা দেয়। এতে করে, ব্যবসার বেশ ক্ষতি হতে পারে।
- আমরা যেহেতু গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসে ই কমার্স ব্যবসা করার কথা বলছি, এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই মার্কেটপ্লেসে প্রতিযোগীতাও অনেক বেশি থাকবে। সঠিক পথে ই কমার্স পরিচালিত না হলে ব্যবসায়িক সুফল পাওয়া বেশ কঠিন।
- এছাড়াও আমরা জানি, ই কমার্স মার্কেটপ্লেস থেকে কেনাকাটা করতে হলে গ্রাহকদের অনেকক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয়, এতে অনেক সময় নানা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, সব ই কমার্স সাইট যে বিশ্বাসযোগ্য তা জোর দিয়ে বলা যাবে না। এধরনের সাইট থেকে গ্রাহক প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
যদিও সম্ভাবনাময় ই কমার্সের এধরনের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করার জন্য, বিশ্বজুড়ে এখন সবধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, এমনকি অনেক সমস্যার সমাধান কিন্তু ইতোমধ্যে হয়েও গেছে।
আমাদের দেশে কীভাবে ই কমার্স শুরু হলো এবং বাংলাদেশে ই কমার্সের ভবিষ্যত কেমন হতে পারে সে সম্পর্কেও আমাদের ধারণা থাকা উচিত। এখন এ বিষয়েই একটু আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশে ই কমার্সের সূচনা
অনলাইন নির্ভর ডিজিটাল পৃথিবী ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। আর এই ডিজিটাল যুগের অনবদ্য সৃষ্টি ই কমার্স। সারা বিশ্বে ই কমার্সের প্রসার চোখে পড়ার মতো। আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, বাংলাদেশও এই ডিজিটাল দৌঁড়ে পিছিয়ে নেই। দেশে এখন ই কমার্সের রমরমা ব্যবসা। অনেক মানুষ ই কমার্সের আশীর্বাদে বেকারত্ব ঘুচিয়ে এখন স্বাবলম্বী।
করোনাকালীন সময়ে আমাদের দেশে ই কমার্সের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এর আগে, ২০০৯ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভিযাত্রায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবিধা শহর থেকে গ্রামেও পৌঁছে যায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংক একই বছরে অনলাইন পেমেন্ট অনুমোদন করায়, ই কমার্সের প্রসার আরো ত্বরাণ্বিত হয়েছে। করোনাকালীন সময়েই মীনাবাজার কিংবা স্বপ্ন ঘরবন্দী গ্রাহকদের সেবা দেয়ার লক্ষ্যে ই কমার্স সাইট তৈরি করেছে এবং গ্রাহকের দোরগোড়ায় পণ্য পৌঁছে দিয়ে গ্রাহকের আস্থা অর্জন করেছে।
বর্তমানে অন্যতম জনপ্রিয় ই কমার্স সাইট রকমারি ডট কম বই কেনাবেচার মাধ্যমে ২০১২ সালে, তাদের যাত্রা শুরু করে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য পণ্য নিয়ে আরো প্রসারিত হয়। এরপরই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক অনলাইন পেমেন্টের জন্য ডেভিড ও ক্রেডিট কার্ডের অনুমোদন দেয়।
এই সময়েই প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা ই কমার্স ওয়েবসাইট নিয়ে যাত্রা শুরু করে সবচেয়ে বড় অনলাইন শপিং মল আজকের ডিল ডট কম। একই বছরে বাংলা ই কমার্স ওয়েবসাইট নিয়ে এখনই ডট কম এবং প্রথম অনলাইন গ্রোসারি ই কমার্স সাইট চালডাল ডট কম তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
এছাড়াও, বাংলাদেশে ই কমার্স ব্যবসার সূবর্ণ সময়ে জার্মান বেইজড কম্পানি রকেট ইন্টারনেটের শপিং সাইট দারাজ, তাদের যাত্রা শুরু করে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া Daraz.com.bd হোম অ্যাপ্লায়েন্স থেকে শুরু করে ইলেক্ট্রনিকস এবং জামাকাপড়ের জন্য বেশ জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্ত একটি ই কমার্স সাইট। এভাবে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে আরো অসংখ্য ছোট-বড় ই কমার্স সাইট তৈরি হয়েছে এবং এসব সাইট গ্রাহকদের অবিরাম সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে ই কমার্সের ভবিষ্যত
বাংলাদেশে ই কমার্সের শুরুটা যে বেশ ভালোভাবেই হয়েছে তা নিশ্চয় এতোক্ষণে বুঝে গেছেন। এই দেশে ই কমার্সের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই দেশে ই কমার্স খাত দিনে দিনে আরো অনেক সম্প্রসারিত হচ্ছে। খাদ্যদ্রব্য, ইলেক্ট্রনিকস, পোশাক, গ্রোসারি, প্রসাধন, অলংকার, ওষুধ থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোনো পণ্য, কী নেই এই ই কমার্স মার্কেটপ্লেসে?
নিত্যনতুন ই কমার্স সাইট যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি পুরোনো ই কমার্সগুলো তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যবসা করছে। যেমনঃ ২০১৮ সালে চীনের ই কমার্স প্রতিষ্ঠান আলিবাবা দারাজ কে অধিগ্রহণের পর এর ব্যবসা পদ্ধতি এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে এবং আলীবাবা ই কমার্সের দীর্ঘদিনের ই কমার্সের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং মায়ানমারেও বর্তমানে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দারাজ। প্রতিবছর তাদের ১১.১১ প্রচারণার মাধ্যমে গ্রাহকের সংখ্যা এবং এই ই কমার্সের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতাও ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
দেশের জনপ্রিয় এরকম কিছু ই কমার্স প্রতিষ্ঠান যে সুনিপুণভাবে এবং দক্ষতার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করছে, এখনই তার সুফল পাচ্ছি আমরা। অনলাইন কেনাকাটায় মানুষ আগ্রহী হচ্ছে। দেশে ই কমার্স সাইট আরো বাড়ছে, নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। নারীরা এই ব্যবসায় অধিক আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে, এজন্যেই, দেশের ৬৪ জেলার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে তৈরি দেশের জনপ্রিয় নারী ই কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘উইমেন অ্যান্ড ই কমার্স ফোরাম’ সংক্ষেপে উই এর পরিধিও আরো প্রসারিত হচ্ছে। আপনার জেনে বেশ ভালো লাগবে যে, কয়েকজন নারী উদ্যোক্তার প্রচেষ্টায় ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এই প্ল্যাটফর্মটিতে বর্তমানে দেশীয় পণ্য নিয়ে ৬ লাখ ৪১ হাজারেরও বেশি নারী উদ্যোক্তা কাজ করছেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, দেশে খুচরা বিক্রির তুলনায় ই কমার্স পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে এই সার্বিক অবস্থার বেশ পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের বাজারে খুচরা বিক্রির ১.৫ শতাংশ অংশ এখন ই কমার্সের দখলে। তাছাড়া, স্মার্ট লজিস্টিক নেটওয়ার্কের কারণে আগে যেখানে ঢাকার বাইরে থেকে ৩৫ শতাংশ অনলাইন অর্ডার আসতো, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান থেকে নিশ্চয় ই কমার্সের প্রবৃদ্ধির হার টা বুঝতে পারছেন?
আরো জানিয়ে রাখি, বাংলাদেশে এখন প্রায় দুই হাজার পাঁচশ’র মতো ই কমার্স সাইট রয়েছে এবং ফেসবুকভিত্তিক ই কমার্স রয়েছে দেড় লাখের অধিক। এ সকল সাইটে নিত্যদিন লক্ষাধিক বা তারো বেশি পণ্য অর্ডার এবং ডেলিভারি হচ্ছে। প্রায় আট হাজার কোটি টাকা সমমানের এই ই কমার্স খাতের বর্তমান বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭৫ ভাগ। দেশের ই কমার্স খাতে যে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা আমি একটা পরিসংখ্যান দিয়ে আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি।
২০১৭ সালে যে খাতে দশ বিলিয়ন টাকা মূল্যের লেনদেন হয়, তা মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ছাপান্ন হাজার আটশ সত্তর কোটি টাকায় এবং ২০২৩ সালের মধ্যে তা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা হবে বলে আভাস দিয়েছিলো গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্স।
এছাড়াও, ডাবলিনভিত্তিক বাণিজ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান, রিসার্চ এন্ড মার্কেটস ডট কম এর দেয়া তথ্যমতে, ২০২৬ সাল নাগাদ এই প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকায়।
বাংলাদেশে ই কমার্সের ভবিষ্যত নিয়ে আপনার মনে নিশ্চয় আর কোনো সংশয় নেই, এই বিষয়ে আর কোনো জিজ্ঞাসাও থাকার কথা নয়। ঠিকমতো পণ্য ডেলিভারির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি গ্রাহকদের যেকোনোরকমের হয়রানি ঠেকিয়ে ই কমার্স ব্যবসার সার্বিক পরিচালনা সঠিকভাবে চালিয়ে নিতে পারলে, বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে বিশ্বের অন্যতম ই কমার্স মার্কেটপ্লেসে পরিণত হবে।
কোন ধরনের ব্যবসার ই কমার্স করা উচিত এবং কেন
অনলাইন নির্ভর যুগে ডিজিটাল বিশ্বে ই কমার্স ব্যবসার কোনো বিকল্প নেই। এই ব্যবসায়িক প্রতিযোগীতার বাজারে টিকে থাকতে গেলে, যেকোনোধরনের পণ্যেরই ই কমার্স করা উচিত। কেননা, দিন যতো যাবে, মানুষ যেকোনো কাজে আরো বেশি অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়বে। ই কমার্সের মাধ্যমে অনলাইনে গ্রাহকদের চাহিদামতো পণ্যের যোগান দেয়া কিংবা তাদের চাহিদা বুঝে সে মতো বিজনেস প্ল্যান সেট করে নিলে ব্যবসার প্রসার হবেই। বিভিন্ন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল জিনিস যেমন, বিভিন্ন মেশিনারিজ বা ইট,বালি কিংবা সিমেন্ট ব্যতীত, বর্তমানে যেকোনো জিনিস অনলাইনেই কিনতে পাওয়া যায়।
আর আমরা যেহেতু দিন দিন আরো বেশি অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়ছি, তাই নিজেদের সুবিধার্থে যেকোনো পণ্যের ই কমার্স সাইট থাকলে তা সহজে আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে। তাছাড়া, ই কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসায়িরাও অনলাইনে নিজেদের বিজনেস অ্যানালাইসিস করে খুব সহজে কাঙ্ক্ষিত গ্রাহকের কাছে তাদের পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিতে পারবে। মোট কথা, ডিজিটাল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যেকোনোধরনের ব্যবসার প্রচার এবং প্রসারের জন্য ই কমার্স এর তুলনা নেই।
শেষকথা
আশা করছি, এই আর্টিকেল পড়ে ই কমার্সের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কে আপনি কিছুটা হলেও ধারণা পাবেন। চাইলে, এখন আপনি সাহস করে একটি ই কমার্স সাইট খুলে নিয়ে ব্যবসা করার চেষ্টা করতেই পারেন।
যদিও সফল ই কমার্স ব্যবসায়ি হতে গেলে ই কমার্স বিষয়ে আরো কিছু খুঁটিনাটি জানতেই হয়। আমি আমার পরবর্তী ব্লগে ই কমার্সের আরো কিছু দিক নিয়ে অবশ্যই আলোচনার চেষ্টা করবো। আজ ছিলো এর প্রথম প্রচেষ্টা।
লেখাটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই সবার সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো। আর আপনার যদি ই কমার্স বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্টে জানালে আমি চেষ্টা করবো সঠিক উত্তরটি দেয়ার।
সবাই ভালো থাকবেন, খুব শীঘ্রই ফিরে আসছি অন্য কোনো নতুন টপিক নিয়ে, ইনশাআল্লাহ।